সাক্ষাৎকার আলহাজ্ব মশিউর রহমান, সংস্কার ও নির্বাচন যেনো প্রলম্বিত না হয়
- আপডেট সময় : ০৩:৪২:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫ ৪৯২ বার পড়া হয়েছে
তহিরুল ইসলাম : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এ সরকারের ৭ মাস পূর্ণ হয়েছে। অল্পদিনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা সমালোচনা।
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। চুয়াডাঙ্গা জেলা দর্শনা পৌর বিএনপির সমন্বয় কমিটির সদস্য আলহাজ্ব মশিউর রহমান সরকারের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের মধ্যে মিল রয়েছে। তার বিশ্বাস, খুব দ্রুত পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। তবে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন যেনো প্রলম্বিত না হয়, তা মাথায় রেখে সরকারকে একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে যে সংস্কার কার্যক্রম করা দরকার, তা করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে দ্রুত তাকে হস্তান্তর করা উচিত। খালেদা জিয়া জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কখনো সরে যাননি। যে কারণে তিনি আপসহীন নেত্রী উল্লেখ করে বলেন, নিরন্তর নিপীড়নের মধ্য দিয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে বিএনপি। আন্তর্জাতিক বিশ্বসহ সব মহলে এখন বিএনপির গুরুত্ব বাড়ছে।
তারেক রহমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু অপকর্ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতগতিতে যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন তাতে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিভাবে প্রশংসা পাচ্ছেন। তারেক রহমান নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে বিএনপি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। রাজনীতির বাইরেও নীরবে-নিভৃতে তারেক রহমানের কাজগুলোও অভাবনীয়।
শুক্রবার বিকালে দর্শনা অফিসএ শাপলা নিউজএর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আলহাজ্ব মশিউর রহমান এসব কথা বলেন।
দেশের চলমান পরিস্থিতি, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্রদের দল গঠন, তারেক রহমানের নীরব জনসেবা ও মানবিকতার অজানা কথা, ভারতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা হয়।
শাপলা নিউজ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৭ মাস পূর্ণ হয়েছে। সরকারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন।
মশিউর রহমান: ৭ মাসের মধ্যে আসলে মূল্যায়ন করাটা খুব কঠিন। তবে তাদের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের মধ্যে মিল রয়েছে। আমার বিশ্বাস, খুব দ্রুত পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে। মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠছে। এতে মনে হয়, সত্যিকার অর্থেই একটা রাষ্ট্র বা সমাজ যেমন হয়, সেদিকেই আমরা যেতে পারবো।
শাপলা নিউজ: রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর। বিএনপি বলছে এজন্য যৌক্তিক সময় দেবে। সেই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে?
মশিউর রহমান: আসলে দিন-তারিখটা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে বেশি দিন যেন প্রলম্বিত না হয়, সেটা মাথায় রেখে একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে যে সংস্কার কার্যক্রম করা দরকার, তা করতে পারে। নির্বাচন কমিশনসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যা রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটা কংক্রিট আইন প্রণয়নের জায়গায় আসতে হবে। তাহলে যাতে ভবিষ্যতে কেউ ইসিকে হাতের মুঠোর মধ্য নিয়ে তাদের দলীয় কাজে ব্যবহার করার সাহস না পায়। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর তো আর কোনো দাবি থাকবে না। সেক্ষেত্রে কিছুটা আশা জাগিয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। যে প্রক্রিয়াই হোক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বড়। সেই দায়িত্ব যাতে যথাযথভাবে পালন করতে পারে, এর নিশ্চয়তা একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে। সেটাই এ মুহূর্তের প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।
শাপলা নিউজ: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আপনি কি মনে করেন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ত্যাগের পটভূমিতেই ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান।
মশিউর রহমান: অবশ্যই। এ আন্দোলন বিগত ১৭ বছরের যে নিরন্তর সংগ্রাম, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা-এ ভয়কে মাথার মধ্যে রেখেই নেতাকর্মীরা ক্রমাগতভাবে লড়ে গেছেন। সাধারণ জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচার। যে কারণে আগে থেকে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো। তার ওপর শেষ আঘাত দিয়েছে ছাত্র-জনতা। অগ্রভাগে থেকে তারা নেতৃত্ব দিয়ে, বিজয় অর্জন করেছেন। সেটা ওই আন্দোলনের পটভূমির ওপরই রচিত হয়েছে।
শাপলা নিউজ: ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যান। নেতারা অনেক সভায় বলেছেন তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হবে তা আগেই চেয়ারপারসন জেনেছিলেন। সমঝোতা করে বিদেশে যেতে পারতেন কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি। আপনার মন্তব্য কী?
মশিউর রহমান: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার অধীনে যারা নির্বাচনে যাবেন, তারা জাতীয় বেইমান। পরে তিনি নিজেই জাতীয় বেইমান হলেন। কারণ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে নির্বাচনে যাচ্ছেন। তখন থেকেই আমরা দেখেছি, খালেদা জিয়া জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কখনো সরে আসেনি। এটা হচ্ছে তার কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা, আপসহীন নেত্রী। এ কারণেই তখন থেকে তরুণ-ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে তরুণরা তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল এবং আকৃষ্ট হয়েছে। যখনই তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন, তখনই সেই নির্দেশ পালন করতে তারা দ্বিধাবোধ করেননি। জনগণের মধ্যেও একটা দৃঢ়বিশ্বাস খালেদা জিয়া যা বলেন, সেখান থেকে তিনি সরে আসেন না। এটা হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এ কারণেই খালেদা জিয়া মানুষের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয়।
শাপলা নিউজ: রাজনীতির বাইরে মানবহিতৈষীৃ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি হাজারো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দায়িত্ব নিয়েছেন হাজারো পরিবারের। একেবারে নীরবে তার এই মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছে। নীরব জনসেবা, মানবিকতার অদেখা দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন?
মশিউর রহমান: তারেক রহমান নীরবে-নিভৃতে যে কাজগুলো করতেন, সেগুলো হয়তো কিছু জানছি, আরও কিছু কাজ আছে, যেগুলো আমরা এখনো জানি না। একটি পরিবারে, বাবা-মা মারা গিয়েছে, এরকম একটা ঘটনা-সে পরিবারের একটি মেয়েকে আজ দীর্ঘদিন তার লেখাপড়া, খরচ তিনি দিচ্ছেন। এই একটা দৃষ্টান্তের কথা বললাম। এরকম হাজারো পরিবারের খরচ তিনি চালাচ্ছেন। তারেক রহমানের অনেক মানবসেবামূলক কাজের কথা শুনে আমাদেরও চোখে পানি এসেছে। অথচ তিনি বহু বছর ধরে তাদের সহযোগিতা করে আসছেন। অনেকে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে হাত-পা হারিয়েছেন, তাদের কৃত্রিম হাত ও পা লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু লোককে অনেক আগে থেকেই উদ্বুদ্ধ করে এ কাজগুলো করতেন। গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোকে নিজের পরিবারের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। এ তো বড় ধরনের মানবিক কাজ। মানবহিতৈষী এ কারণেই তাকে বলা যায়, লোকদেখানো কাজের চেয়ে নীরবে-নিভৃতে তারেক রহমান যে কাজগুলো করেছেন, তা অভাবনীয়। দৃশ্যমান যে ঘটনাগুলো দেখছি, গ্রেফতার হলে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, গুলিবিদ্ধ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সেবা, ওষুধ-সবকিছু তিনি লক্ষ রাখছেন বাইরে থেকে। মিডিয়ায় দেখেই তিনি দায়িত্ব নেন। এটা অসাধারণ কাজ, যেটা উনি পারেন। এখন আমরা বিএনপি পরিবার নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে মানবসেবার কাজগুলো করছে।
শাপলা নিউজ: ছাত্র-জনতা গণহত্যার সঙ্গে জড়িতরা বেশির ভাগই এখনো অধরা। আপনার মন্তব্য কী?
মশিউর রহমান: জড়িতদের ধরার কাজ, বিচারের মুখোমুখি করার কাজ সরকারের। তারাই তা করবে। যারা নিষ্ঠুর-নিপীড়ন চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। খুব দ্রুত তাদের বিচারের আওয়ায় আনতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
শাপলা নিউজ: বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা অপকর্ম করছেন বলে আভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে দলের অবস্থান কী?
মশিউর রহমান: এটা অনেকটাই অপপ্রচার। মূল বিষয়টা হচ্ছে আমার সন্তান যদি অপরাধ করে, তাকে যদি শাস্তি দিই, তাহলে পিতা হিসাবে একটা মেসেজ যাবে সবার কাছে যে পিতা খুব কড়া, তার সন্তান অপরাধ করেছে ছাড়েনি। সেখানে কেউ কেউ অপকর্মে লিপ্ত। নিরন্তরভাবে আমরা কাজ করছি। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কার, পদ স্থগিত, শোকজ ক্রমাগতভাবে চলছে। মনে হয়েছে, এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া না হলে মাত্রা আরও বাড়ত। ১৭ বছরে আমাদের অনেক নেতাকর্মীর বাড়িঘর দখল করেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠার দখল করেছে, দোকানপাট দখল করেছে। ক্ষোভ থাকাটা তো স্বাভাবিক। অনেকে ঢাকায় গিয়ে সিএনজি ও রিকশা চালিয়েছে, নাইটগার্ডের চাকরি করেছে। ৫ আগস্টের পর তারা সবাই বাসায় ফিরেছে। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকতেই পারে, এটা অমূলক নয়। কিন্তু তারপরও শক্ত হাতে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছি। এই যে পদক্ষেপের কথাগুলো দু-একটা মিডিয়া ছাড়া অন্যগুলো প্রচার করছে না। শুধু কে কী করেছে, তাই লিখছে। সত্য সংবাদ ছাপাবেন, কে কী করছে দলের নাম দিয়ে যেটাও বলবেন এবং এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে দ্রুত যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাও দিবেন। এটাও থাকা উচিত। হতে পারে আওয়ামী লীগ একটা দল ছিল সেটা তো বিদায় নিয়েছে, এখন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে জনগণের চোখে একটা নেগেটিভ অবস্থান তৈরি করা যায় কি না, কেউ কেউ চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। এটাতে আর লাভ নেই। দ্রুতগতিতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে তাতে মানুষ প্রশংসা করছে।
শাপলা নিউজ: এ মুহূর্তে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?
মশিউর রহমান: এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের যে বিজয়, তা সংহত করে সংগঠনকে গুছিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাওয়া। যে পরিবেশের কারণে জনগণ ভোট দিতে যায়নি, সেই পরিবেশটা থাকবে না, সেই নিশ্চয়তা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে পেতে চাই। সেই কাজটি করবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
শাপলা নিউজ: বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের প্রতি দলের কোনো নির্দেশনা আছে কি না?
মশিউর রহমান: সবাই সংযত আচরণ করুন। কেউ বাড়াবাড়ি করবেন না কোনো ক্ষেত্রেই। কারণ, পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকে না। পরিস্থিতি নানা সময়ে নানাদিক হতে পারে। আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে জনগণ। সে কারণে জনগণ যাতে বিরক্তবোধ না করে, সেজন্য সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সচেতন থেকে কাজ করতে হবে। নিয়মমাফিক যে সাংগঠনিক তৎপরতা-কার্যক্রম ও রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো বলা দরকার, সেগুলো বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা বলবেন। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠন করে যাবো।
শাপলা নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য শাপলা নিউজ এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
মশিউর রহমান: আপনাকে এবং শাপলা নিউজ এর সব পাঠককে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।